মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:৪৯ পূর্বাহ্ন

কান্তজীউ মন্দির: স্থাপত্য শিল্পের অনন্য উদাহরণ

প্রতীক ওমর
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২১
  • ৭২৯ Time View
দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দিরের মূল ভবনের সামনের দৃশ্য। ছবি: প্রতীক ওমর।

দেয়ালজুড়ে অলঙ্করণ। পোড়ামাটিতে দারুণভাবে ফুটে তোলা। তিনটি পৌরাণিক কাহিনীর ঘটনাবলী নিখুঁতভাবে আঁকা হয়েছে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায়। মহাভারত, রামায়ণের পুরো কাহিনী চিত্রিত হয়েছে। সেই সাথে অসংখ্য প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয় ঘণিষ্ঠতার ছবি এবং তৎকালীন সমাজ-সামাজিকতার বাস্তবরুপ ফুটে উঠেছে পরতে পরতে। পোড়ামাটির তৈরি এসব শিল্প বিস্ময়কর লাগে ভ্রমণ এবং শিল্পপ্রেমিদের চোখে। বাংলাদেশের যে কোন স্থাপত্য শিল্পের চেয়ে এটি বেশি দৃষ্টি নন্দন। নাম কান্তজীউ মন্দির। বাংলাদেশের উত্তরের জেলা দিনাজপুরে অবস্থিত। ভ্রমণ পিপাসুদের সব সময় আকর্ষণ করে থাকে এই মন্দিরটি। দৃষ্টি নন্দন এমন শৈল্পিক নিদর্শন চোখজুড়িয়ে দেয়।

কান্তজীউ মন্দির নির্মাণকাল: দিনাজপুরের স্থানীয় লেখক উপেন রায় কান্তজীউ মন্দিরের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে একটি বই লিখেছেন। ‘ইটে গাঁথা মহাকাব্য: কান্তজীউ মন্দির’ নামে। ওই বইয়ে ‘কান্তজীউ মন্দির’ নির্মাণকাল উল্লেখ আছে ১৭০৪ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন মহারাজা প্রাণনাথ মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কাজ শেষ হওয়ার আগেই তিনি ১৭২২ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পরে মহারাজের দত্তকপুত্র মহারাজ রামনাথ ১৭৫২ খৃষ্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ শেষ করেন। এছাড়াও মন্দিরের দেয়ালে আটকানো ফলক থেকেও নির্মাণকাল জানাযায়। মন্দিরের পূর্বকোণের ভিত্তি দেয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত সংস্কৃত ভাষায় লেখা কালানুক্রম জ্ঞাপক একটি শিলালিপিতে নির্মাণকাল উল্লেখ আছে।

দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দিরের প্রবেশ পথ। ছবি: প্রতীক ওমর।

মন্দিরের নামকরণের ইতিহাস: মহারাজা প্রাণনাথ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত। আর শ্রীকৃষ্ণের নানা গুণের কারণে তাকে প্রায় ১০৮ নামে ডাকা হতো। এসব নামের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে শ্রীকান্ত। মহারাজা প্রাণনাথ শ্রীকৃষ্ণের ‘কান্ত’ নামকে বেছে নিয়ে তার সাথে ‘জীউ’ সম্মানসূচক উপাধি যোগ করে মন্দিরের নাম দিয়েছেন ‘কান্তজীউ মন্দির’। ফলে এই ঐতিহাসিক মন্দিরটি কান্তজীউ মন্দির নামেই পরিচিতি লাভ করে। পরে ওই মন্দিরের নাম অনুসরে ওই এলাকার নামকরণ হয় কান্তনগর।

কান্তজীউ মন্দিরের স্থাপত্য শৈল্পিকতা: মূলত তিনটি পৌরাণিক কাহিনীকে প্রাধান্য দিয়ে মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছে। মনুষ্য মূতি ও প্রাকৃতিক দৃশ্য নানাভাবে তুলে ধরা হয়েছে মন্দিরের গায়ে। মহাভারত ও রামায়ণের কাহিনীর সাথে কৃষ্ণের নানা কাহিনী, সমকালীন সমাজ জীবনের বিভিন্ন ছবি এবং জমিদার অভিজাতদের বিনোদনের চিত্র কারুকাজ্যময় করে তোলা হয়েছে। পোড়ামাটির এ শিল্পগুলির বিস্ময়কর প্রাচুর্য, মূর্তির গড়ন কোমল ভাব ও সৌন্দর্য এতো যত্নের সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, বাংলার যে কোন ম্যূরাল চিত্রের চেয়ে কান্তজীউ মন্দির উৎকৃষ্টমানের। মন্দির দেয়ালের অলংকরণের দৃশ্য গভীরভাবে দেখলে অবাক লাগে। দর্শনার্থীরা তাক লাগিয়ে যায় এর শৈল্পিকতা দেখে।
মন্দিরের বাইরের দেয়ালের উত্তর দিকের প্রতিমূর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষ্ণ বলরাম। কৃষ্ণের বিভিন্ন বিয়ের ছবি; গোয়ালিনী দন্ডের দ্ইু মাথায় শিকায় ঝোলানো দুধ ও দৈ বহনের দৃশ্য। এছাড়াও এখানে সূক্ষ্মভাবে দৃশ্যমান করা হয়েছে বিভিন্ন যুদ্ধেকে। এখানে অন্তর্ভুক্ত আছে কংসের দানবাকৃতির খুনে হাতি কবল্লপীড়ার ধ্বংস। মথুরায় কংসের সঙ্গে যুদ্ধে কৃষ্ণকে অংশগ্রহণে বিরত করতে না পেরে রাধার জ্ঞান হারানোর দৃশ্য। এতে আরও দেখানো হয়েছে একটি বৃত্তের ভেতর নৃত্যরত রাধাকৃষ্ণের যুগলশূর্তিসহ রস-মন্ডল ও এর সাথে অন্যান্য সহায়ক মূর্তি।

দর্শনার্থী দুই শিশু

কান্তজীউ মন্দিরের নির্মাণ শিল্পীগণ ছিলেন অত্যন্ত উচ্চমানের। তারা তাদের মেধা এবং মননকে একভূত করে অসাধারণ এই স্থাপত্য নিদর্শন তৈরি করেছেন। পরিশীলিত এবং পরিণত শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, যেখানে সমন্বিত ধারায় অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে অলঙ্করণ করা হয়েছে।
১৮৯৭ সালের একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে মন্দিরটির নয়টি চুড়া ভেঙ্গে যায়। ওই সময় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে মন্দিরটি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা গিরিজানাথ বাহাদুর ধ্বংস হয়ে যাওয়া নয়টি শিখর (চূড়া) বাদে মন্দিরটির ব্যাপক পুনর্গঠন করেছিলেন। পিরামিড আকৃতির মন্দিরটি তিনটি ধাপে উপরে দিকে উঠেছে এবং তিন ধাপের কোণগুলোর উপরে মোট নয়টি অলংকৃত শিখর রয়েছে। মন্দিরের চারদিকে খোলা খিলান পথ রয়েছে যাতে যে কোন দিক থেকেই পূজারীরা ভেতরের পবিত্র স্থানে রাখা দেবমূর্তিকে দেখতে পায়। বর্গাকৃতির মন্দিরটি একটি আয়তাকার প্রাঙ্গনের উপর স্থাপিত। এর চারদিকে রয়েছে পূজারীদের বসার জায়গা। পাথরের ভিত্তির উপর দাঁড়ানো মন্দিরটির উচ্চতা ৫০ ফুটেরও বেশি।

কান্তজীউ মন্দিরের উৎসব সমূহ: এই মন্দিরের সাবেক সহকারি পুজারি কান্ত চ্যাটার্জি তৃণমূল খবরকে বলেন, কান্তজীউ মন্দিরে ধর্মীয় সব উৎসব মর্যাদাসহকারে পালিত হয়। এসব উৎসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাসমেলা। বাংলা মাসের পুরো কার্তিকজুড়ে কান্তজীউ মন্দিরের চলে রাসমেলা। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথীতে রাসলীলা উপলক্ষে শুরু হয় এই উৎসব। দেশ এবং দেশের বাইরের হাজারো তীর্থ যাত্রীর পদচারণায় মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে। উৎসব চলাকালে ঢোল, কাঁশীর বাজনা এবং নারীদের উলুধ্বনিতে রাসমেলা জমে ওঠে।
এরপর ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথীতে মন্দিরে দোলপূর্ণিমা উৎসব হয়। ঘরে আগুন জ¦ালিয়ে এবং হলি ছিটিয়ে এই দিনটি পালন করে থাকেন পূণ্যকামীরা। এই উৎসবেও বিপুল পরিমাণ দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। এছাড়াও তারকব্রহ্ম নামযজ্ঞ উৎসব, শিবরাত্রী ব্রত উৎসব, স্লানযাত্রা উৎসব কান্তজীউ মন্দিরের পালিত হয় বলে কান্ত চ্যাটার্জি জানান।

দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দিরের শ্রীকৃষ্ণমূর্তি রাখার আসন। ছবি: প্রতীক ওমর।

পর্যটকদের পদচারণা: উৎসব চলাকালীন সময়গুলোতে পাশের দেশ ভারত, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা কান্তজীউ মন্দির দর্শনে আসেন। এছাড়াও বছরের প্রায় সব সময় কমবেশি দেশীয় পর্যটকদের পদচারণা থাকে। ভ্রমণ এবং ইতিহাস পিপাসুদের আকর্ষণীয় স্থান এটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি দপ্তরের একজন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম কান্তজীউ মন্দিরে ঘুড়তে এসে তৃণমূল খবরকে তার অনুভূতি ব্যক্ত করেন এভাবে, আমি এর আগেও একবার এই মন্দির দেখতে এসেছিলাম। আমি অবক হয়ে মন্দিরের স্থাপত্যশিল্প উপভোগ করেছি। আমি আবারও মন্দিরটি দেখতে এসেছি। মন্দিরের শিল্পকর্মগুলো অন্যকোন স্থাপনার মধ্যে এতোটা নিখুঁতভাবে ফুটে তোলা দেখিনি। তিনি বলেন, আগের চেয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা এবং মন্দিরের পারিপাশির্^ক চিত্রের উন্নতি হয়েছে।
কথা হয় শিবগঞ্জ থেকে দেখতে আসা মিলন মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, আমি এই মন্দিরের নাম শুনেছি। দেখার সুযোগ হয়নি। আজ পেশাগত কাজের ফাঁকে দেখতে এসেছি। খুব ভালোলাগলো। তিনিও এই মন্দিরের স্থাপত্যশৈলি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন বলে জানান।

কান্তজীউ মন্দিরের পিলারে পৌরানিক কাহিনীর বিভিন্ন দৃশ্য এভাবেই ফুটেতোলা হয়েছে। ছবি: প্রতীক ওমর।

কান্তজীউ মন্দিরের ম্যানেজার আপন চন্দ্ররায় তৃণমূল খবরকে বলেন, ঐতিহাসিক এই কৃষ্ণমন্দিরটি নির্মাণে ৪৮ বছর সময় লেগেছে। প্রখ্যাত জমিদার মহারাজা প্রাণনাথ এই মন্দিরের পাশাপাশি দিনাজপুরের রাম সাগর খনন করেছেন। এছাড়াও তিনি ছোট বড় অসংখ্য মন্দির নির্মাণ করেছেন। দূর-দূরন্তে থেকে এখানে পুজা করতে আসা কৃষ্ণ ভক্তদের নামমাত্র টাকার বিনিময়ে খাবার খাওয়ানো হয়। এছাড়াও বাইরের দর্শনার্থীদের রাত্রী যাপনের জন্য শহরে সরকারি এবং বে-সরকারি ছোট-বড় হোটেল রয়েছে বলেনও তিনি জানান।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2020 trinomulkhobor.com
Developed by: A TO Z IT HOST
Tuhin