অনেকের কাছে তিনি বিল্লু নামে পরিচিত। আদরের নাম। বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষার বিখ্যাত সেই গান‘ এ বিল্লু চ মাছ মারবেন যাই/ ট্যাংরা ছাতেন গচি মাগুর যদিল কিছু পাই/এ বিল্লু চ মাছ মারবের যাই’। বিখ্যাত এই গান লিখে এবং নিচের কণ্ঠে গেয়ে তিনি বিল্লু হয়ে উঠেছেন অগ্রজদের মনিকোঠায়। তিনি আর কেউ নন, ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ। বাংলাদেশের বিশ্বাসীধারার সাংস্কৃতিক অঙ্গণে তিনি ক্রমান্বয়ে লক্ষত্র হয়ে উঠছেন। ছোট বড় সবার কাছে সমান প্রিয় এই বহুমাত্রিক গুনিজনের জন্ম গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কালপানি গ্রামে। কিশোর এবং তরুণ কালের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন বগুড়ায়। বগুড়ার মাটি ও মানুষের সাথে মিশেগিয়ে গান কবিতার চর্চা করেছেন। মঞ্চ মাতিয়েছেন অসংখ্য রাত দিন। দেশ স্বাধীনের পরের বছর ১৯৭২ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। পিতা মোজাফফর রহমান আখন্দ এবং রত্নগর্ভা মাতা মর্জিনা আখন্দ। ড. আখন্দ বর্তমানে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।
আজ তিনি তার জন্মদিনে মন খারাপের পশরা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সময় পার করছেন। তার মন খারাপের প্রধান কারণ হচ্ছে আজকের দিনে ঠিক দশ বছর আগে তার আদরের প্রিয় ভাতিজা বুলবুল পৃথিবী ছেড়ে পরপারে পারিজমিয়েছেন। সেই বেদনা তাকে এবং তার পুরো পরিবারকে বেদনাতুর করে তুলেছে। ড. আখন্দ শারীরীক অসুস্থতা নিয়ে বর্তমানে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া একটি স্ট্যাটার্স আপলোড করেছেন তার ফেসবুক ওয়ালে। সেই পোস্টটি হুবহু তুলেধরা হলো।
‘সনদপত্র জানিয়ে দিয়েছে, আজ আমার জন্মদিন। জীবনবৃক্ষ থেকে ঝরে গেলো আরো একটি পাতা, একটি বছর। জন্মদিন মানেই হিসাব নিকাশের মাপযন্ত্র। দেখতে দেখতে জীবনের প্রান্তরে অনেক ঋতুবদল হয়েছে, জীবন নদীর বুকে বয়ে গেছে অনেক গ্রীস্ম-বর্ষা, শরৎ-হেমন্ত, শীত-বসন্ত। অর্ধশতাব্দীর মাপকাঠিতে জীবনমাঠে প্রত্যাশার ফসল কতোটা ফলেছে তা ভাবিয়ে তোলে সবসময়।
হারানোর বেদনায় যুক্ত হয়েছে অনেক কষ্টপালক। কলিজার টুকরো বুলবুলকে হারিয়ে বুকের নদীতে শূণ্যতার ঝড় বয়ে চলে সবসময়। চোখের সামনে চলে গেলো কত ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার মানুষ। গতকাল প্রিয়বন্ধু প্রফেসর ড. ফারুক হোসাইন চলে গেলেন বুকের খাঁচা ভেঙে। সোনার পাখিরা বুকের বাঁধন খুলে এভাবেই একে একে উড়ে যাচ্ছে। জানি না, কখন আমারও ডাক আসবে উড়ে যাবার। কি নিয়ে হাজির হবো মহান মালিকের পবিত্র দরবারে। হে পরওয়ারদিগার, তোমার সামনে ভালোবাসার তোহফা নিয়ে দাঁড়াবার মতো হৃদয় দাও, সক্ষমতা দাও।
ক্ষুদ্র এই জীবনে অনেক পেয়েছি। ভোগের তালিকা অনেক সমৃদ্ধ, অনেক লম্বা। মহান আল্লাহ আমাকে দুহাতে দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্রই আমার ঋণ। মুঠোমুঠো ভালোবাসা নিয়ে আমি স্বার্থবাদীর মতো হৃদয়-আকাশ ভরিয়ে তুলেছি। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, অগ্রজ-অনুজ সকলের কাছে অনেক পেয়েছি। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরে শিক্ষকগণের ভালোবাসা এবং দুআ আমার অন্ধকার রাস্তায় আলোকবর্তিকা হিসেবে সামনে টেনেছে। শিক্ষকতা জীবনের ক্ষুদ্র প্রয়াসে ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে আমার ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির স্বপ্নপথে অগ্রজ-অনুজদের পুষ্পিত টান আমাকে পাগলপারা বানিয়েছে। সর্বোপরি জীবন পথের প্রতিটি স্তরে সকলেই দুআ এবং ভালোবাসার ফলগুধারায় সিক্ত করে বাড়িয়ে দিয়েছে আমার ঋণের বোঝা। হে পরওয়ারদিগার, ভালোবাসার কাঙাল আমি। এ মাঠে কখনো খরার আভাস জাগিও না।
আজ এইশুভক্ষণে পরিবার পরিজন ছেড়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালের কক্ষে বসে লিখছি। কেবলই হৃদয় উঠোনে ভয়ের কাঁপন, প্রত্যাশার নক্ষত্র। ভালো কাজে কখনো বিফল করো না। বরকত দাও। সুস্থতার নেয়ামতে পরিপূর্ণ করো। স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের পথে সফলতার সাথে এগিয়ে নাও হে রাব্বুল আলামিন।’
উল্লেখ্য, ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ ইতিহাসের নানা বিষয়ে তাঁর ৮টি গ্রন্থ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পড়ানো হয়। রোহিঙ্গা সমস্যার উপর বাংলাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম স্বার্থক গবেষক। তিনি এম.ফিল এবং পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন রোহিঙ্গা বিষয়কে কেন্দ্র করেই। তাঁর ‘আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস’ এবং ‘রোহিঙ্গা সমস্যা ও বাংলাদেশ’ গবেষণা গ্রন্থদুটি এ বিষয়ের মাস্টার পিস গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
প্রফেসর আখন্দ বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক। শিশুদের শব্দভাষা এবং কোমল মনের অনুভূতিগুলো ভালোভাবেই বোঝেন তিনি। শিশুমনের কোমলতা এবং কৌতুহলকে ঘিরেই তিনি সাহিত্য রচনা করেন। ছড়া-কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি লিখে চলেছেন নিয়মিত। ‘জলজ রাজার দেশে’ এবং ‘জ্বীনের বাড়ি ভূতের হাঁড়ি’ গল্পগ্রন্থদুটি শিশুসাহিত্যে মজার সংযোজন। ‘স্বপ্ন দেখি মানুষ হবার’ ‘ধনচে ফুলের নাও, ‘মামদো ভূতের ছাও, ‘জ্বীন পরী আর ভূতোং, তাঁর মজাদার শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ।
বড়োদের জন্যও কবিতা, ছড়া, গান, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছেন ড. আখন্দ । ‘মনটা অবুঝ পাখি, ‘জীবন নদীর কাব্য, ‘তোমার চোখে হরিণমায়া, ‘গুমর হলো ফাঁস, ‘স্বপ্নফুলে আগুন, ‘ছড়ামাইট, ‘হৃদয় বাঁশির সুর’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলো কবিতা, ছড়া এবং গানের জগতে তাঁর উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ‘মোহনা’ এবং ‘শব্দকলা’ নামে দুটি সাহিত্য পত্রিকার সফল সম্পাদকও তিনি। ছড়া, কবিতা গল্প এবং সম্পাদনার ভেতর দিয়ে তিনি নতুন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন পরিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক জগৎ গড়ার। তাঁর বক্তৃতাও বেশ উপভোগ্য। ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ হিসেবে তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে দারুণ জনপ্রিয়।
গাইবান্ধা জেলায় জন্ম হলেও তিনি বগুড়াসহ সারা দেশের শহর-গ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্কুল, মাদরাসা, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার কারণে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন তিনি। সাংস্কৃতিক মঞ্চ থেকে শুরু করে সাংবাদিকতার মাঠেও তিনি সরব। তিনি বগুড়ার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সমন্বয় সাহিত্য সাংস্কৃতি’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, বাংলাদেশ ইতিহাস একাডেমি, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস, রাজশাহী পরিচয় সংস্কৃতি সংসদ, শব্দকলাসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। ভার্চুয়াল মিডিয়াতেও তিনি বেশ সরব থাকেন।
তার জন্মদিনে চিলোকেঠা এবং তৃণমূল খবর পরিবারের পক্ষথেকে লালগোলাপ শুভেচ্ছা।