সরকারি খাদ্য গোডাউনে ধান দিতে সীমাহীন দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। তথ্য গোপন করে ভুয়া নামের তালিকা অনুমোদন দিয়েছে খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ যাচাইবাছাই কমিটির সদস্যরা। একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে সাথে নিয়ে অনিয়ম করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ভুয়া তালিকার ওই সব কৃষকদের ব্যাংক একাউন্টও জালিয়াতির মাধ্যমে খোলা হয়েছে। ভুয়া জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরি করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজসে একাউন্ট খোলা হয়েছে। এমন অভিযোগ উঠেছে প্রকৃত কৃষকদের পক্ষ থেকে।
ঘটনা বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলা খাদ্য অফিসের। এখানে সরকারিভাবে কৃষকদের থেকে ধান ক্রয়ে কৃষকদের সাথে জালিয়াতি করা হয়েছে। তাদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করে একটি চক্র সরকারি গোডাউনে ৩০০ কেজি করে ধান দিয়ে রীতিমত টাকাও তুলেছে।
উপজেলায় প্রায় ৫৬ হাজার কৃষক রয়েছে। তার মধ্যে কৃষি এফসের মাধ্যমে সরকারি খাদ্য গোডাউনে ধান সরবরাহের জন্য ১২ হাজার কৃষক আবেদন কারেন। তার মধ্যে ২১৫জন কৃষকের নাম লটারীর মাধ্যমে চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
সরজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, মূল তালিকায় ওঠা নামের পাশে মোবাইল নম্বরের মালিকের কোন মিল নেই। নামের ব্যক্তিদের বেশির ভাগই জানে না তাদের নামের তালিকা হয়েছে। তাদের নামে গোডাউনে ধান দেয়া হয়েছে সেটিও জানানেই। এমনকি তারা নিজেরা ধান দেয়ার জন্য আবেদন পর্যন্ত করেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেছেন, সোনাতলার কয়েকজন ধান ব্যবসায়ী কর্মকর্তাদের সাথে সিন্ডিকেট করে নিজেরাই ব্যাংকে একাউন্ট খুলেছে। দুই একজন ব্যাক্তি স্বশরীরে ব্যাংকে আসলেও বেশির ভাগ একাউন্টধারী ব্যাংকে আসেনি। ব্যবসায়ীরা প্রভাবশলী হওয়ার কারণে ব্যাংক কর্মকর্তারা বাধ্য হয়েছেন ব্যক্তি ছাড়াই একাউন্টগুলো খুলতে। তিনি বলেন, জনতা এবং অগ্রনী ব্যাংক সোনাতলা শাখায় অধিকাংশ একাউন্টগুলো খোলা হয়েছে।
ওই ব্যাংক কর্মকর্তা আরো বলেন, একাউন্ট খোলার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইবাচাই করার সুযোগ দেয়নি সিন্ডিকেটগুলো। তারকাছে ধান ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেটের সদস্যদের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, সোনাতলা পৌরসভার চেয়ারম্যানের ভাই আবুল কালাম পুটু, পল্লবসহ আরো বেশ কয়েকজন। পরে পুটু এবং পল্লবের সাথে কথা বললে তারা এসবের মধ্যে নেই বলে নিজেদেরকে নির্দোষ দাবী করেছেন।
কথা হয় তালিকায় নাম থাকা সোনাতলা বালুয়া এলাকার নয়ামিয়ার মোবাইল ফোন নম্বরে। ফোনের ওপার থেকে রিসিভ করেন শাখাওয়াত নামের একজন রেল কর্মকর্তা। তার বাড়ি উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে। তিনি বলেন, আমিতো আবাদই করি না। ধান দিবো কোথায় থেকে। আর ফোন নম্বরইবা ওই তালিকায় গেলো কী করে?
সোনাতলার ইমান উদ্দিন সরকারকে ফোন দিলে ওই নম্বর রিসিভ করেন সুখানপুকুর এলাকার গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, সরকারি গোডাউনে ধান দেয়ার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
উপজেলার শাজাহান আলীকে ফোন দিলে তিনি বলেন, আমি মুর্খ মানুষ। জীবনে কোন দিন সরকারকে ধান দেইনি। আমার নামে হয়তো প্রতারকরাকে ধান দিয়ে টাকা তুলেছে।
এভাবেই প্রায় তালিকার সব নম্বরের ব্যক্তির সাথে মিল পাওয়া যায়নি। চরম পর্যায়ের জালিয়াতি করে কার ধান- কে দিয়েছে সরকারি খাদ্য গুদামে, আর টাকা যাচ্ছে কার অ্যাকাউন্টে সেই খবর কেউ জানেনা। অনুসন্ধানে এমন সীমাহীন দুর্নীতির তথ্য বেড়িয়ে আসলে এর দায় কোন দপ্তর নিতে চাচ্ছে না। এ্যাপসের দোহাই দিয়ে সবাই নিজেদেরকে নির্দোষ প্রামাণের চেষ্টা করছেন।
সোনাতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, অনেক কৃষক পুরো উপজেলাজুড়ে। তাদের একটা একটা করে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব না। তিনি বলেন, কেউ যদি ভুয়া তথ্য দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করে সেক্ষেত্রে আমাদের করার কিছু নেই। তবে, ধান গ্রহণের সময় খাদ্য নিয়ন্ত্র জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে তালিকার ব্যাক্তির মিল আছে কি না, মোবাইল নম্বর মিল আছে কিনা এসব দেখে মিল পেলে তারপর ধান নেয়া দরকার ছিলো। রেজিষ্ট্রেশনের সময় ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে এসএমএসের মাধ্যমে ওটিপি কোর্ড যাওয়ার কথা থাকলেও কীভাবে অন্যের ফোন ব্যবহার করে রেজিষ্ট্রেশন হলো? এমন প্রশ্নে জবারে তিনি বলেন, হয়তো এ্যাপসের নিয়ন্ত্রকরা কোনভাবে এসএমএস বন্ধ রেখেছিলো।
সরকারি খাদ্য গোডাউনে ধান প্রদানের কৃষক যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। আর সদস্য সচিব উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। কৃষি বিভাগ সদস্য হিসেবে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে প্রকৃত কৃষক বাছাই হওয়ার কথা। এতোগুলো ধাপ কীভাবে ভুয়া তথ্যে পার হলো জানতে চাইলে সোনাতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন বলেন, এমনটা হওয়ার কথা নয়। কোথায় কীভাবে এমন হলো সেটা তদন্ত না করে কিছু বলা যাবে না। তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতে আছেন এজন্য বেশি কথা বলতে পারবেন না বলে ফোন রেখে দেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য সোনাতালা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক শাহ মো: শাহেদুর রহমানের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে, বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত} হুমায়ুন কবির বলেন, বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি মাত্র। দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। দায়িদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিৎ করা হবে।