চলতি জুন মাস শুরু হয় জোড়া খুনের মধ্য দিয়ে। ঠিক মাসের মধ্যভাগে ঈদুল আযহার রাতে (১৭ জুন) আবারো জোড়া লাশ পড়ে বগুড়া শহরে। এছাড়াও বছরজুড়ে খুনের পরিসংখ্যান চোখ উপরে ওঠার মত। আবার কাততালিয় হলেও সত্য বিগত কয়েক বছরধরে ঈদের দিনে খুনের ঘটনা ঘটছেই।
বগুড়াতে কেন এতো খুন? যখন জোড়া লাশ পড়ে তখন কর্মকর্তারা কোথায় থাকেন? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এখন বগুড়ার সর্বত্র।
২১ জুন বুধবার। বগুড়ার শহীদ খোকন পার্কে চায়ের দোকানে আড্ডায় জমেে উঠেছে বেশ কিছু তরুণ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আলোচনা হচ্ছে জোড়া খুনের বিষয়ে। শহরের বাসিন্দা সবাই। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম।
একজন বলছেন, বগুড়াতো খুনের নগরী। এখানে খুন করা সবচেয়ে সহজ। ইচ্ছে হলেই খুনিরা যে কাউকে খুন করতে পারে। অপর একজন বলে উঠলেন, শহরে যখন জোড়া লাশ পড়ে তখন কর্মকর্তারা কোথায় থাকেন? পাশের আরেক বন্ধু বলে উঠলেন ‘কেন, জানিস না? পুলিশের কর্তারা তখন মেতে থাকেন গানের আড্ডায়, ঈদ উৎসবে’
তাদের কথার সূত্রধরে ঈদের রাতে জোড়া খুনের সময় এবং পুলিশ সুপারের বাস ভবনে ঈদ উৎসবের আড্ডা মেলানোর চেষ্টা করি।
১৭ জুন। ঈদের দিন দিবাগত রাত। শরীফ ও রুমন খুনের শিকার হয়। কারণ অতি সমান্য বিষয়। খুন হওয়া রুমনের মোটর সাইকেল বগুড়া জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ টিপুর গাড়িতে ধাক্কা লাগে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরই জের ধরে আসামীরা ওই দিন রাত ১২টায় শরিফ শেখ, রুমনকে মীমাংসার কথা বলে ডেকে নিয়ে খুন করে।
খুনিরা যখন ঠান্ডা মাথায় তাদের কার্যক্রম শেষ করে ঠিক তখনও বগুড়া জেলা পুলিশ সুপারের বাস ভবনে চলছিলো ঈদ উৎসব। সেই উৎসবে যোগ দেন বগুড়া জেলার ১২টি থানার অফিসার ইনচার্জগণ। যোগ দেন সবগুলো ফাঁড়ির ইনচার্জ ও তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জও। রাতের শুরু থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে আয়োজন। পুরো জেলার দায়িত্বশীলরা অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। অনিরাপদ হয়ে ওঠে বগুড়া। খুনিরা নির্ভয়ে তাদের কার্যক্রম চালাবে এটাই স্বাভাবিক। এমন মন্তব্য এখন জেলাজুড়ে চলমান।
শুধু কী এবারের ঈদেই খুন? না। অনেকটা ধারাবাহিকভাবে খুন সংঘটিত হয়ে আসছে বগুড়ায়। ২০২৩ সালে বগুড়ায় ঈদের ছুটিতে (ঈদুল ফিতর) পৃথক ঘটনায় তিনজন খুন হয়েছে। বগুড়া জেলা পোস্ট অফিস থেকে অফিস সহায়ক এর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটরা ইউনিয়নের মনিনাগ গ্রামে প্রতিপক্ষের মারপিটে রবিউল ইসলাম (২১) ও জেলা সদরে অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক রেজাউল করিম পান্না সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। ২০২২ সালে ঈদুল ফিরতের রাতে বগুড়ায় আব্দুর রাজ্জাক সরকার (৬৫) নামে এক আমেরিকা প্রবাসীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বত্তরা। ৩ মে দিবাগত রাত দেড়টায় সদর উপজেলার বাঘোপাড়া মহিষবাথান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ২০২০ সালে ঈদ (ঈদুল ফিতর) উপলক্ষে সেমাইয়ের ব্যবসায় লাভের মাত্র ৪০০ টাকা কম দেওয়া নিয়ে বিরোধের জের ধরে বগুড়ার শিবগঞ্জে ভাতিজার ছুরিকাঘাতে চাচা শামীম হোসেন (৩৫) খুন হয়েছেন। ঈদের আগের রাতে (২৪ মে) উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের বিহারপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ২০২০ সালে অপর ঘটনায় বগুড়ায় ঈদের দিন এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় বগুড়া শহরের উপকণ্ঠ দ্বিতীয় বাইপাস সড়কের সাবগ্রাম জিগাতলা এলাকায় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
নিহত তরুণ মো. বিটল মিয়া (২০) বগুড়া সদর উপজেলার রবিবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ও বগুড়া শহরের একটি টেইলার্সের দরজি শ্রমিক ছিলেন। ২০১৯ (১ জুন) বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় ঈদের (ঈদুল ফিতর) ছুটি কাটাতে নিজ গ্রামে আসা নাঈম হোসেন (১৯) নামে এক যুবককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নাঈম ওই গ্রামের ওমর ফারুকের ছেলে। সে ঢাকায় শ্রমিকের কাজ করতো।
এদিকে, রাত পোহালেই বিভৎস খুনের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সোস্যাল মিডিয়া খুললেই লাশের ছবি। প্রায়ই খুন হচ্ছে বগুড়ায়। কখনো জেলা শহরে, কখনো উপজেলায়। প্রত্যন্ত গ্রামও বাদ নেই খুনের তালিকায়। ধান ক্ষেত, নদী নালা এমনকি শহরের ড্রেনগুলোতেও মিলছে লাশ।
বগুড়া জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী- ২০২১ সালে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৮২টি। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯-এ। ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত খুন হয়েছে ৮০ জনের উপরে। চলতি বছরেও ২০ খুন পার হয়েছে। এসব খুনের বেশিরভাগ হয়েছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং কিশোর গ্যাংদের দ্বারা।
প্রায় ঈদেই যখন খুনের ঘটনা ঘটছে ঠিক তখন গভীর রাত পর্যন্ত থানা এবং জেলার পুলিশ কর্মকর্তারা এক সাথে উৎসবে মেতে ওঠেন। এতে পুরো জেলা অনিরাপদ হয়ে ওঠে। এমনটা মন্তব্য করে সুশাসের জন্য নাগরিক বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিন বলেন, “মুখ চেনা কিছু ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ দিয়ে পুলিশ সুপারের বাস ভবনে প্রতি ঈদে যে আয়োজন হয় সেটা অনেকটা দৃষ্টিকটু। আর একসাথে সবগুলো ওসি তাদের স্টেশন কীভাবে ত্যাগ করে ওই আয়োজনে যোগ দেয় সেটা আমার মাথায় আসে না। আমি জানতে চাই ওসিদের সার্ভিস রুলে কী স্টেশন ত্যাগ করা এতোটাই সহজ?”
বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করতে পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি বরাবরের মতই ফোন রিসিভ করেননি।
পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আব্দুর রশিদের সাথে দেখা করে খুনের ঘটনা, সবগুলো থানা, ফাঁড়ি, তদন্তকেন্দ্রের ওসিদের নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত উৎসবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।