শনিবার রাত ১টা। চার সদস্যের পরিবারের সকলেই ঘুমিয়ে ছিলেন। আসিফ মাহতাব তার নিজ কক্ষে কম্পিউটারে কিছু একাডেমিক কাজ করছিলেন। হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। দরজা খুলতেই ডিবি পরিচয়ে ১০ থেকে ১৫ সদস্যের একটি দল বাসার ভেতর প্রবেশ করেন। তাদের গায়ে ডিবি লেখা জ্যাকেট এবং হাতে ছিল লাঠি। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সাদা পোশাকে। এভাবেই ডিবি পরিচয়ে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎসকে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিচ্ছিলেন ছোট বোন নাফিসা। এ ঘটনার পরপরই রোববার সকালে তার বাবা ও মা ছুটে আসেন মিন্টো রোডে। এ সময় ডিবি’র পক্ষ থেকে আসিফকে তুলে আনার বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি।
রাজধানী উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের ১০/এ সড়কের নিজ বাসা থেকে তাকে তুলে আনা হয় বলে দাবি করেন তার পরিবার। বোন নাফিসা বলেন, আমাদের বাসায় একটি পুতুল রয়েছে। এটি দেখলে মনে হবে জীবন্ত। যেন কারও দিকে তাকিয়ে আছে। এ সময় ডিবি পুলিশ পরিচয়দানকারী সদস্যরা পুতুলটি খুলে চেক করে দেখেন যে এরমধ্যে কোনো গোপন ক্যামেরা আছে কিনা।
আমরা জানতে চাই ভাইয়ার অপরাধ কি? জবাবে তারা বলেন, আপনার ভাইকেই জিজ্ঞেস করেন তার কি অপরাধ। তিনি ভালো বলতে পারবেন। আসিফের কক্ষে কড়া নেড়ে তাকে ডাকা হয়। আসিফ তখন কক্ষের বাইরে বেরিয়ে আসলে ডিবি পুলিশের সদস্যরা বলেন, আপনার সঙ্গে যা যা নেয়া দরকার গুছিয়ে নেন। তখন আমরা ভাইয়ার কিছু জামা-কাপড়, তার স্পাইনাল কর্ডের সমস্যার জন্য নিয়মিত যে ওষুধ খান তা দিয়ে দেই। ভাইয়ার মুঠোফোনটি তারা সঙ্গে নিয়ে নেয়। বাসার অন্য কোনো ডিভাইস তারা নেয়নি। ডিবি’র কোনো জোন থেকে তারা এসেছেন কিংবা তাদের নাম ইত্যাদি কিছুই বলেননি। কিছুক্ষণ পর তারা ভাইয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যান। আসিফের বোন বলেন, আমার ভাই তো কোনো অন্যায় করেননি। তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের নৈতিক দাবির সমর্থন জানিয়েছেন। এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পক্ষে কিছু লেখালেখি করেন। হয়তো এটাই তার অন্যায় হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু এটাতো হতে পারে না। ভাইয়া কোথায় আছেন কেমন আছেন কিছুই জানি না। আমরা ভাইয়াকে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে ফেরত পেতে চাই। ডিবি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কোনো মন্ত্রী-এমপি’র রেফারেন্স নিয়ে গেলে তারা ভাইয়ার বিষয়ে তথ্য দেবেন। কিন্তু আমরা তো মধ্যবিত্ত। আমাদের তো কোনো এমপি-মন্ত্রী আত্মীয় নেই। আমার ভাই কোনো অপরাধী না। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরি ছাড়ার পর অনলাইন একাডেমিক কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে যাদের কাছেই ভাইয়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে সাহায্য চাচ্ছি সকলেই প্রশাসনের ভয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে সকাল থেকেই রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস’র বাবা-মা। তারা একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ছেলে আসিফ মাহতাবের কোনো সন্ধান পাননি। মিন্টো রোডে উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আসিফ মাহতাবের বাবা বিমান বাংলাদেশের সাবেক কর্মকর্তা শাহাবুর রহমান বলেন, কী কারণে আমার ছেলেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে আসা হলো জানি না। আমরা ছেলের খোঁজ নিতে মিন্টো রোডের কার্যালয়ে এসেছি। কয়েক ঘণ্টা ধরে এখানে অপেক্ষা করছি। ভেতর থেকে জানানো হয়েছে আমরা আনলে তো ফোন করে জানাতাম। এ অবস্থায় আমরা শঙ্কায় আছি। আমরা আসলে আসিফ মাহতাবের খোঁজ চাই।
আমার ছেলে কয়েকদিন আগেও বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসছে। সে শুধু সাধারণ মানুষের কথা ভাবে। সাধারণ ছাত্রদের অধিকারের কথা বলে। আসিফ সবসময় বলতো পুলিশের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। ছেলেকে আটকের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার ছেলে ফেসবুকে লেখালেখি করতো। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তো অনেক ঘটনা ঘটেছে। সেটা তো আপনারা জানেন। এরপর সে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে না। আসিফের স্কুল শিক্ষিকা মা সালমা জাহান বলেন, আমরা ভয়ে আছি। দেশের এই পরিস্থিতিতে বুঝতেছি অনেককেই তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু আমার ছেলে তো রাজনীতি করে না। তাকে তুলে আনার সুনির্দিষ্ট কারণ তো আমাদের জানাতে হবে।
এদিকে আটকের চার ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন আসিফ মাহতাব। সে কারণে তিনি আটক হতে পারেন বলে ধারণা করেন বোন নাফিসা। আলোচিত এ শিক্ষক কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনেও মাঠে ছিলেন। সর্বশেষ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আসিফ মাহতাব লেখেন, আপনারা জানেন অনেক মানুষকে কোনো ভ্যালিড কারণ ছাড়া গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আপনারা এটাও জানেন আমি আপনাদের পাশে ১০০ ভাগ ছিলাম। এখনো আছি। এই অপরাধের কারণে আমাকে যদি গ্রেপ্তার করা হয় কিংবা গুম করা হয় তাহলে আপনারা কী করবেন? তিনি আরও লেখেন, না আমি ভয় পাচ্ছি না। যারা নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করতে পারে, ওই কাপুরুষদের ভয় পাবো কেন? আমি মৃত্যুর জন্য সবসময় প্রস্তুত। সবারই মরতে হবে। এটাই সত্য। কিন্তু আমি জনগণের মাইন্ডসেট বুঝতে চাই। এই উম্মাহ কি এক? নাকি এই উম্মাহ স্বার্থপর, বিভক্ত?’ এর আগে পাঠ্যবইয়ের শরীফ থেকে শরীফা গল্পের পাতা ছিঁড়ে আলোচিত-সমালোচিত হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস। গোয়েন্দা উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ডিসি) বদরুজ্জামান জিল্লু বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। ব্র্যাকের কোনো শিক্ষক কিংবা আসিফ মাহতাব নামে কাউকে আমরা হেফাজতে আনিনি।
সূত্র: মানবজমিন